সেই থেকে ‘নিশিযাপন’ বাড়িটায় জায়গা হয়ে গেল ডুলুর৷ শহর থেকে সরে এসে মধ্যযৌবনে অবনীমোহন এখানেই দু’কাঠা জায়গা কিনেছিলেন৷ সবে তখন অবনি হয়েছে৷ একটু-একটু করে একতলা বাড়িটা শেষ করলেন৷ একদিন স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘কমলিনী, সকালে বেরিয়ে যাই অফিসে৷ ফিরি তো সেই রাতে৷ বাড়িতে থাকা বলতে শুধু রাতটুকুই৷ তাই বাড়িটার নাম ‘নিশিযাপন’ রাখলে কেমন হয়?’
কমলিনী হেসে চলে গিয়েছিলেন৷ সেই থেকে বাড়ির এই নামটাই বলবৎ হয়ে গিয়েছিল৷
তারপর বছর দশেক হল অবনীমোহন গত হয়েছেন৷ কমলিনীও সংসারের মায়া কাটিয়েছেন সাত বছর হল৷ ওঁরা অবিনের বিয়েটা দিয়ে যেতে পরেননি৷ বাড়ির দোতলাটা শুরু করেছিলেন অবনীমোহন৷ অবিন সেটা শেষ করেছে৷ তারপর বিয়ের জন্য মনস্থির করেছে৷
যাক, বন্ধুবান্ধব না থাকলে কী যে হত! বিশেষ করে অমলেন্দু৷ একা হাতে প্রায় সবটাই করেছে ও৷ বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করা থেকে শুরু করে বিয়ের কার্ড, ডেকরেটর, ক্যাটারার, এমনকী বিয়ের বেনারসী পর্যন্ত, অমলেন্দু না থাকলে অবিন একা সবটা ঠিকঠাক করে উঠতে পারত কিনা নিজেরই সন্দেহ হয় অবিনের৷ বাসরঘরে বেচারা ভালোভাবে মজাটুকুও করতে পারেনি, ওদিকে বউভাতের সব ব্যবস্থা করতে হবে যে!
পূর্ণাকে নিয়ে গাড়ি যখন রওনা হয়ে শ্বশুরবাড়ির দিকে বেশ কিছুটা চলে এসেছে, তখন হঠাৎ হাউহাউ করে কেঁদে উঠেছিল পূর্ণা৷ অবিনও কিছুটা হতচকিত হয়ে পড়েছিল৷ পূর্ণার ছোট মাসতুতো ভাই, পূর্ণার দুই বন্ধুও প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি৷ কাঁদতে কাঁদতে পূর্ণা বলেছিল, ‘ও মা, আমার ডুলু? আমার ডুলু কোথায়? ডুলুকে আনা হয়নি৷ গাড়ি ঘোরাও এক্ষুনি৷’
ডুলু হল পূর্ণার পুতুল৷ পূর্ণার পাঁচ বছরের জন্মদিনে বাবা ওকে কলকাতা থেকে এই পুতুলটা এনে দিয়েছিলেন৷ প্রায় এক ফুটের মতো লম্বা, নীল জামা আর কালো প্যান্ট পরা পুতুলটা আবার চোখ পিটপিট করে নাড়ালে৷ সেই থেকে ডুলুকে কখনও কাছছাড়া করেনি পূর্ণা৷ এই নিয়ে সকলে কম হাসাহাসি করেনি৷ কিন্তু পূর্ণা কান দেয়নি সে সব কথায়৷
লোকে বলত, ‘আহা, বেচারির ভাই নেই তো! তাই পুতুলটাকে অমন করে জড়ায়৷’ আসলে ভাইবোন কিচ্ছু না, ডুলুকে ওর ভাল লাগে, খুব ভাল লাগে৷ ওকে ছেড়ে পূর্ণা থাকতে পারে না৷ তবু গাড়ি ঘোরানো হল, ফিরে যাওয়া হল পূর্ণাদের বাড়ি৷ একঘর লোক সবাই তো থ’৷ না, এটা পূর্ণার বড্ড বাড়াবাড়ি৷ কেউ কেউ পূর্ণার বাবাকেও দুষতে ছাড়ল না৷ কারও কোনও কথায় কান দেওয়ার সময় কোথায় পূর্ণার? পূর্ণা প্রায় দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এল ডুলুকে৷ জড়িয়ে ধরে চুমু খেল কয়েকবার৷ তবে শান্ত হল পূর্ণা৷
সেই বিয়ের পর বউভাতের দিন থেকেই ডুলু এ বাড়িতেই থাকে৷ শুধু থাকে নয়, সে যেন এ বাড়ির একজন মেম্বার৷ লোকজন বলাবলি করল, ‘বাড়িতে ওই দুটি তো প্রাণী৷ আর আছে কাজের মেয়ে দয়ার মা৷ বছর ঘুরতে দাও৷ কোল জুড়ে একটা ছেলেপুলে আসুক আগে৷ তখন সব ঠিক হয়ে যাবে৷’
কিন্তু তার আগেই বাধল বিপত্তি৷
সবে বউভাত হয়েছে কয়েকদিন হল৷ সব চুকেবুকে গেছে৷ আত্মীয়স্বজন কেউ নেই৷ বাড়িটা বেশ ফাঁকা লাগছে৷ আসলে ফাঁকা-ফাঁকা থাকতে ভাল লাগে অবিনের৷ ছেলেবেলা থেকে একা-একাই তো থেকেছে অবিন৷ মা রান্না আর রামায়ণ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন সারাদিন৷ যখনই একটু সময় বের করতেন, তখনই আঁচলে একবার রামায়ণটা মুছে নিয়ে বসে যেতেন পড়তে৷ অবিন একদিন মজা করে মাকে বলেছিল, ‘বিদ্যাসাগরের মা ভগবতীদেবীও তোমার মতো অত রামায়ণ পড়ত না মা!’
মা বলেছিলেন, ‘তুই তোর পড়া নিয়ে ব্যস্ত৷ তোর বাবার তো শহর থেকে ফিরতে সেই রাত৷ তাই নিজের মধ্যে ডুবে থাকি রে৷’
এই নিজের মধ্যে ডুবে থাকা স্বভাবটা অবিন মনে হয় মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছে৷ এখন পূর্ণা এসেছে৷ সেই একা ডুবে থাকার ব্যাপারটা একটু-একটু করে যেন কাটছে অবিনের৷
৷৷দুই৷৷
আজ সন্ধেবেলা গোল একটা চাঁদ উটেছে ওদের বড় চাঁপাগাছটার মাথায়৷
অবনীমোহন এই চাঁপাগাছটা লাগিয়েছিলেন৷ বাড়ির ডানদিকে নাকি চাঁপাগাছ লাগাতে হয়৷ কমলিনী এর সঠিক ব্যাখ্যা জানতেন না৷ অবনীমোহনও জানার চেষ্টা করেননি কোনওদিন৷ অবিন অনেক ভেবে আবিষ্কার করেছে, আসলে বাড়ির দক্ষিণ দিকে চাঁপাগাছ লাগালে, যখন ফুল ফুটবে, তখন গন্ধটা বাড়ির মধ্যে ভেসে আসবে৷ কিন্তু অবনীমোহন বেঁচে থাকতে একবারও ফুল ধরল না গাছটায়৷ পাশের অকুলেন্দুকাকু অবনীমোহনকে ডেকে বলেছিলেন, ‘অবনীদা, আপনার চাঁপাগাছটা বাঁজা৷ ও ফুল দেবে না৷’
এক সময় অবনীরও মনে হয়েছিল এটা বাঁজা চাঁপাগাছ৷ নিজের মনে ভেবেছিলেন, ফুলগাছ কি কখনও বাঁজা হয়? হয়তো হয়৷ হয়তো জগদীশচন্দ্র জানতেন৷
অবনীমোহন দেখে যেতে পারেননি৷ কিন্তু তাঁর সেই সাধের চাঁপাগাছ এখন কেমন সোনালি ফুলে ভরে যায়৷ গন্ধে গোটা ‘নিশিযাপন’ বাড়িটা কেমন উড়ন্তি হয়ে যায় সন্ধেবেলা৷ এর আগে সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে এসে অবিন হাতমুখ ধুয়ে বেতের চেয়ারটা নিয়ে বসে যেত দোতলার বারান্দায়৷ দয়ার-মা চা-মুড়ি দিয়ে চলে যেত বাড়ি৷ বারান্দার সামনে চাঁপাফুলের গাছ৷ ফুল ফুটলে অবিন চুপচাপ বসে থাকত, বসেই থাকত৷ বাবা-মা’র কথা মনে পড়ত খুব৷ আসলে ফুলের গন্ধ বুঝি প্রিয়জনকে মনে পড়িয়ে দেয়৷
আজ তো অমন করে চাঁপা ফুটেছে৷ অমন করে গোল চাঁদটাও উঠেছে আজ৷ অবিন দুটো বেতের চেয়ার পাতল বারান্দায়৷ দয়ার-মা রাতের খাওয়ার ব্যাপারটা সব বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছে পূর্ণাকে৷ একতলায় রান্নাঘর৷ দয়ার-মা সব রান্না করে দোতলায় খাওয়ার টেবিলে সাজিয়ে দিয়ে যায়৷ পূর্ণার গলা শুনতে পাচ্ছে অবিন, ‘দয়ার মা, তুমি কী গো? এই এত খাব আমরা দু’জনে?’
‘কইটুকুনি রেঁধেছি গো বউদি৷ দু’জন মানুষ খাবে তো, নাকি!’ বলে দয়ার-মা চলে গেল৷
অবিন ডাকল, ‘অপূর্ণা, বারান্দায় এসো, তোমার মতো চাঁদ উঠেছে, দেখবে এসো৷’
বাড়িতে যখন কেউ থাকে না, অবিন মাঝে-মাঝে পূর্ণাকে ‘অপূর্ণা’ বলে ডাকে৷ পূর্ণা এসে ধপাস করে বসে পড়ল চেযারে৷ তারপরই উঠে পড়ল, ‘ও মা, আমার ডুলুটা একলা পড়ে আছে সোফায়৷’
অবিনের চাঁদ দেখায় একটা মেঘের টুকরো যেন আড়াল করে দাঁড়াল৷ পূর্ণা এসে ডুলুকে কোলে নিয়ে বসল চেয়ারে, ‘ও মা, কী সুন্দর! চাঁদটা গোল হতে এখনও একটু বাকি৷ কবে পূর্ণিমা গো?’
অবিন হেসে বলল, ‘’তোমার পূর্ণিমা কবে জানি না৷ তুমি পাশে থাকলে আমার রোজই পূর্ণিমা৷’
অবিন পূর্ণাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেল৷ ঝট করে মাথাটা সরিয়ে নিল পূর্ণা, ‘বারান্দায় এ সব? কেউ দেখে ফেললে?’
অবিন বলল, ‘যার দেখার কথা সে কিন্তু লজ্জায় এদিকে তাকালই না৷’
পূর্ণা ভয় পাওয়া গলায় বলল, ‘কে গো? ওদিকের বাড়ির লোকটা?’
অবিন চাপা গলায় বলল, ‘নাঃ, ওই আকাশবাড়ির চাঁদটা৷ কেউ নিজের বউকে চুমু খেলে ওর তাকাতে বয়েই গেছে৷ পরের বউকে চুমু খেলে চাঁদরা চোখ ফেরাতে পারে না’ বলে অবিন পূর্ণাকে জড়িয়েমড়িয়ে একশা৷
পূর্ণা নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, ‘উঃ, তুমি এমন ভাবে ধরলে, আমার ডুলুটা কেমন চিপসে গেল!’ চাঁদের মুখ আড়াল করা সেই মেঘটা অবিনকে চোখ ভ্যাঙাল যেন৷ অবিন প্রসঙ্গ পাল্টাল, ‘পূর্ণা, অনেক দিন আগে আমি চাঁদ নিয়ে একটা গল্প পড়েছিলাম৷’
‘বলো না গল্পটা৷’
‘গল্পটা এরকম৷ ঠিক তোমার মতো দেখতে পুতুল-পুতুল একটা মেয়ে৷ তার ছিল চাঁদের অসুখ৷ রোজ রাতে চাঁদ তার কাছে শুতে আসত৷ সে স্পষ্ট দেখতে পেত, চরাচর যখন নিঝুম হয়ে আসত, চাঁদটা তার কাছে এসে বসত৷ তাকে জড়াত, আদর করত, তার হাতের আঙুলে আঙুল জড়াত, তার পায়ে পা জড়াত৷ তার সঙ্গে শুত, ঠোঁটে ঠোঁট রাখত, জিভে জিভ রাখত৷ মেয়েটা নড়তে চড়তে পারত না৷ হাঁসফাঁস করত৷ জ্যোৎস্নারা শক্ত চোখে চাঁদকে পাহারা দিত জানলার বাইরে৷’
‘তুমিই যদি পুতুলকে পুতুল বলে মেনে নিতে পারতে,তা হলে তো মিটেই যেত৷ ডুলু যদি একটা পুতুলই, তাহলে ওর প্রতি তোমার অত টান কেন? ওর গায়ে একটু আঁচড় লাগতে দাও না৷ও কি মানুষ?’
‘ও মা, এ কী অলুক্ষুণে কথা!তারপর? তারপর কী করত মেয়েটা?’
‘তারপর আর কী?মেয়েটা একদিন লজ্জার মাথা কেটে বাড়িতে ঘোষণা করল, সে চাঁদকে বিয়ে করবে৷’
‘ও মা, বলে কী!তারপর কী হল?’
‘তারপর?’
‘তারপর অবিন তার বউকে নিয়ে চলল বিছানায়’ বলেই পূর্ণাকে কোলে তুলে নিয়ে উধাও হয়ে গেল অবিন, চাঁদ আর চাঁপাগাছের চোখের আড়ালে৷ ডুলু তখনও পূর্ণার হাত ধরা৷
চাঁদ আর চাঁপাগাছটা মাথা উঁচু করে দেখতে লাগল অন্ধকারের মতো জ্যোৎস্নায় আর-এক চন্দ্রগ্রহণের দৃশ্য৷
৷৷তিন৷৷
ডুলুকে নিয়ে বিব্রত বোধ করতে লাগল অবিন৷ একদিন বলল, ‘আচ্ছা পূর্ণা, এই ডুলুময় জীবন আমার একদম ভাল লাগে না৷ ও থাকলে আমি যেন তোমাকে পুরোপুরি পাই না৷ ও কেমন করে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে৷ তোমাকে ছুঁতে গিয়ে আমার মনে হয় ডুলু এমন ভাবে তাকায়, যেন তোমাকে ছোঁয়ার অধিকার শুধু ডুলুরই৷ওর ওই চোখ পিটপিট করা আমি সহ্য করতে পারি না, তুমি বিশ্বাস করো৷’
পূর্ণা খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ল অবিনের গায়ে, ‘’তুমি এক্কেবারে ছেলেমানুষ! ডুলু তো একটা পুতুল বই তো নয়৷ ও মা, ও কি মানুষ নাকি?’
‘ডুলু যদি পুতুলই,তবে তুমি ওকে ছেড়ে থাকতে পারো না কেন?ওর গায়ে একটু জোরে লেগে গেলে তুমি অমন করে শিউরে ওঠো কেন? আমি বলি কী, আমরা ডুলুকে তোমার বাপের বাড়িতে রেখে আসি৷’
অমনি ঝাঁঝিয়ে উঠল পূর্ণা, ‘ও মা, না না৷ ও এখানেই থাকুক না গো! ওর পিছনে তোমার কি কোনও খরচ হয় যে, ও তোমার সংসারের একটা বোঝা? ও কি তোমার প্রতিপক্ষ?’
‘আমার তো সেরকমই মনে হয়৷ তা হলে এক কাজ করো, তুমি তো সারাদিন ডুলুকে নিয়েই থাকো, তখন তো আর আমি বারণ করি না৷ কিন্তু আমি অফিস থেকে ফেরার পর তোমার ডুলুকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করা চলবে না৷ ওকে অন্য একটা ঘরে রেখে দেবে, কেমন?’
‘তুমি এত নিষ্ঠুর কেন গো?একটা পুতুলকে নিয়ে…’
‘তুমিও একটা পুতুলকে নিয়ে এত ঝামেলা করছ কেন?ওকে শহরে যে নতুন ‘পুতুল লাইব্রেরি’ হয়েছে, চলো ওখানে দিয়ে দিই? এক-একজন ছোট ছেলেমেয়ে ওকে ইস্যু করে বাড়ি নিয়ে যাবে, খেলবে, যত্নআত্তি করবে, তারপর ফেরত দিয়ে যাবে৷ ইচ্ছে করলে, তোমার মন খারাপ হলে, তুমিও ওকে দু-চারদিনের জন্য নিয়েও আসতে পারবে বাড়িতে, মন্দ কী?’
‘আমার ডুলু লোকের বাড়ি বাড়ি ঘুরবে?তুমি বলো কী?’
পূর্ণা অনেক কিছুই বুঝতে চায় না৷পূর্ণা বড়লোকের মেয়ে বলে কি এত অবুঝ?বড়লোকের মেয়েরা এত অবুঝ হয় কেন?মা থাকলে পূর্ণার এই সব ব্যাপার ঠিক সামলে নিতেন৷আজকের সন্ধেটা খুব মুখভার করে আছে৷ বারান্দায় তেমন করে আজ চাঁদের ছায়া পড়েনি৷ চাঁপাফুলের গন্ধও যেন আজ কোথাও উধাও হয়ে গেছে৷ অন্ধকারে দুটো জোনাকি উড়ে-উড়ে খুনসুটি করছে৷ আজকাল পূর্ণা ছোটখাট খুনসুটিও করে না৷ অবিন ভাবল, জোনাকিদের জীবনে তো কোনও ডুলু নেই৷
অনেকক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না৷ পূর্ণার কোলে ডুলু৷ পূর্ণা ডুলুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে৷ হঠাৎ অবিন বলল, ‘অ্যাই, তোমার মনে নেই নিশ্চয়ই, কাল আমাদের অফিস থেকে পিকনিক আছে?’
পূর্ণা কেমন ভ্যাবলা মুখে তাকাল অবিনের দিকে৷ কী বলবে যেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না পূর্ণা৷ অবিন তাড়া লাগাল, ‘চলো, ব্যাগ গুছোতে হবে তো! নাকি তুমি একাই গুছিয়ে নেবে?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি একাই গুছিয়ে নিচ্ছি৷ তুমি বোসো৷’ বলে উঠে গেল পূর্ণা৷
সকাল-সকাল বেরিয়ে পিকনিক স্পটে পৌঁছতে দশটা বাজল৷ নদীর ধারে ঝাউগাছে ঘেরা খুব সুন্দর জায়গাটা৷ পূর্ণা বাস থেকে নেমেই দৌড়ল নৌকো দেখতে৷ অফিসের দশ-বারোজনকে নিয়ে অনিরুদ্ধবাবু এই পিকনিকটার আয়োজন করে আসছেন আজ কয়েক বছর৷ পারিবারিক এই পিকনিকে এবার প্রথম এল পূর্ণা৷ সকলেই দারুণভাবে পূর্ণাকে রিসিভ করলেন৷ বউদিরা পূর্ণাকে মাঝখানে নিয়ে ব্রেকফাস্ট খেলেন৷ সেনগুপ্ত বউদি পূর্ণার বড় ব্যাগটা নিয়েও কম মজা করলেন না, ‘পূর্ণা এখন থেকে কেমন বড় ব্যাগ নেওয়ার প্র্যাকটিস করে রাখছে৷ কী গো মেয়ে, খবর আছে নাকি কিছু?’
সবাই খুব হাসছিলেন৷ পূর্ণা ব্যাগ খুলে হাত মোছার তোয়ালে বের করতে গিয়ে বেরিয়ে পড়ল ডুলু৷ একসঙ্গে অনেকেই বলে উঠলেন, ‘ও মা পূর্ণা, ছেলে-পুতুল! হবে হবে, তোমার ছেলে হবে, এই আমরা বলে রাখলাম৷’
পূর্ণা পড়ল আরও লজ্জায়৷ অবিন এগিয়ে এল পূর্ণাকে বাঁচাতে, ‘না না, এটা ওর ছেলেবেলার পুতুল৷ ও ডুলুকে ছাড়া থাকতে পারে না তো৷ তাই এনেছে সঙ্গে করে৷’
বউদিরা তবুও মজা করতে ছাড়লেন না, ‘অবিনঠাকুরপো, তোমার পেটে-পেটে এত? এতদিন খবরটা দাওনি?’
অবিন অনেক চেষ্টা করেও কাউকে বোঝাতে পারল না যে ওটা পূর্ণার ছেলেবেলার পুতুল৷ পিকনিক থেকে ফিরে অবিন পূর্ণাকে বলল, ‘তুমি ডুলুকে পিকনিকে নিয়ে যাবে, কই আমাকে তো বলোনি? পিকনিকে ডুলুকে না নিয়ে গেলেই কি হত না?কতবার বলেছি, ডুলুকে নিয়ে তোমার এই সব আমার একদম ভাল লাগে না? অত লোকের সামনে লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার জোগাড়!’
পূর্ণা চোখ পিটপিট করে বলল, ‘ব্যাগটা বড় হয়ে যাচ্ছে দেখে প্রথমে আমি ডুলুকে নিইনি৷ ওকে সরিয়ে রাখতে ও এমনভাবে ছলছল চোখে আমার দিকে তাকাল যে, না নিয়ে আর পারলাম না৷’
‘কিন্তু ডুলুকে ছেড়ে তাকাতে তো তোমাকে অভ্যাস করতে হবে পূর্ণা৷ আমি যখন তোমাকে… তখন ও যেভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে৷ আমি তোমার থেকে তখন পিছিয়ে আসি৷ না, এর একটা বিহিত করো পূর্ণা৷ আজ থেকে তুমি ডুলুকে আমাদের মাঝখানে শোয়াবে না৷’
পূর্ণাও অনেক চেষ্টা করেছে৷ ডুলুকে পাশের ঘরে রেখে এসে শুয়েছে অবিনের পাশে৷ কিন্তু অবিন ঘুমিয়ে পড়লে পা টিপেটিপে গিয়ে পাশের ঘর থেকে ডুলুকে নিয়ে এসে শুইয়েছে মাঝখানে৷ পারেনি, পূর্ণা ডুলুকে ছেড়ে থাকতে পারেনি৷
রাতে খেতে গেল না অবিন৷ অনেকবার ডাকল পূর্ণা৷ অবিন উঠল না৷ দয়ার-মা’র রান্না করে রেখে যাওয়া খাবার টেবিলে পড়েই থাকল৷ খেল না পূর্ণাও৷ সোফায় শুয়ে থাকল অবিন৷ পূর্ণা গিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়৷ মাঝরাতে অবিন উঠে গিয়ে দেখল, পূর্ণা ডুলুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে৷ কী ছেলেমানুষতে ভরা পূর্ণার মায়াময় মুখটা৷ মেয়েটা সত্যি ছেলেমানুষ৷
ঘর থেকে বারান্দায় এসে দাঁড়াল অবিন৷ আকাশের দিকে তাকাল৷ এখনও কালপুরুষটা আকাশ পাহারা দিচ্ছে৷ জোনাকিরা সন্ধের আবেগ নিয়ে এখনও সমানে উড়ে যাচ্ছে করঞ্জা ঝোপের নীচে৷ কোনও একটা রাতপাখি ডেকে উঠল দূরে৷ এখনও শীত আসেনি৷ জ্যোৎস্নার মতো মিহি হিম পড়ছে চাঁপাগাছের পাতায়, কুঁড়িতে, ফুলে৷ অনেকক্ষণ রেলিংয়ে মাথা রেখে বসে থাকল অবিন৷ একটু একটু করে দুঃখ গলতে শুরু করল অবিনের মধ্যে৷ ডালে-পাতায় ঘুরে ঘুরে কেউ যেন কাল যে চাঁপাফুলের ফোটার কথা, তাকে জাগিয়ে যাচ্ছে৷
৷৷চার৷৷
না, অবিন আর রাগ করবে না পূর্ণার ওপর৷ সবটুকু সুখ দিয়ে পূর্ণাকে ভরিয়ে দেবে অবিন৷ অবিন ভাবল, আমাদের মধ্যে ওই যে সাঁকোটা ভেঙে যাচ্ছে একটু-একটু করে, ওটাকে মমতা দিয়ে জুড়ে ফেলতে হবে৷ দয়ার-মা অবিনকে বলেছে, ডুলুকে নিয়েই সারাটা দিন কাটে পূর্ণার৷ অবিন ভাবল, পূর্ণাকে একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে কেমন হয়? অমলেন্দুকে এসব কথা বলেছে অবিন৷ ডাক্তারের কথায় সায় দিয়েছে অমলেন্দু৷ খুঁজে পেতে এক মনোবিদের কাছ থেকে আজ ঘুরেও এসেছে পূর্ণাকে নিয়ে৷ প্রথমে যেতে রাজি হয়নি পূর্ণা৷ বলেছিল, ‘আমার কী হয়েছে যে, তুমি আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাইছ?’
অবিন বলেছিল, ‘না, মানে ওই ডুলুর ব্যাপারটা৷ ওকে নিয়েই তো আমাদের মধ্যে যত ঝঞ্ঝাট৷ দেখি, উনি যদি একটা ভাল উপায় বার করে দিতে পারেন৷’
‘উপায় আর কী ? তুমি যদি একটা পুতুলকে মানুষ বলে মনে করো, তাহলে ডাক্তারবাবুরই বা কী করার আছে? খুব সামান্য ব্যাপার! তুমি পুতুলকে পুতুল বলে ভাবতে শুরু করো, দেখবে আর কোনও সমস্যা নেই৷’
‘তুমিই যদি পুতুলকে পুতুল বলে মেনে নিতে পারতে,তা হলে তো মিটেই যেত৷ ডুলু যদি একটা পুতুলই, তাহলে ওর প্রতি তোমার অত টান কেন? ওর গায়ে একটু আঁচড় লাগতে দাও না৷ও কি মানুষ?’
ডাক্তারবাবুও প্রায় একই কথা বললেন, ‘সমস্যাটা হচ্ছে, আপনারা দু’জনেই পুতুলটাকে পুতুলের বেশি কিছু বলে মনে করেন৷ আপনারা পুতুলটাকে আজ থেকে পুতুল বলে ভাবতে শুরু করুন, দেখবেন, সব মিটে যাবে৷ তার চেয়ে বড় কথা হল, আপনাদের মধ্যে একটা সত্যিকারের পুতুলের বড় দরকার৷ চটপট তার আয়োজন করে ফেলুন!’ বলে ডাক্তারবাবু হা হা করে হেসে উঠলেন৷ লজ্জায় পূর্ণার প্রায় মাটিতে মিশে যাওয়ার অবস্থা৷
কোনওরকমে অবিন বলল, ‘ঠিক আছে ডাক্তারবাবু৷ দরকার হলে পরে যোগাযোগ করব৷’ ডাক্তারবাবুর চেম্বার থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত কেউ একটাও কথা বলল না৷ না পূর্ণা, না অবিন৷ যেন ওরা কেউ কাউকে কোনওদিন দেখেনি৷ কেউ কাউকে চেনেও না কোনওদিন৷ একই গন্তব্যের বাসের দুই অচেনা যাত্রী যেন৷
বাসে ফিরতে ফিরতে জানলা দিয়ে বাইরের চলচ্ছবি দেখতে দেখতে আকাশ-পাতাল অনেক ভাবছিল অবিন৷ ডাক্তারবাবুর শেষ কথাটা কি ভেবে দেখেনি অবিন? কিন্তু পারেনি৷ যখনই পূর্ণাকে গ্রহণ করতে গেছে, তখনই ডুলুর উপস্থিতি নৌকোকে অন্য স্রোতে ঘুরিয়ে দিয়েছে৷ ডুলুর চোখ নড়লে কেমন ভয় পেয়ে যায় অবিন৷ একবার তো অবিন পূর্ণাকে বিছানায় যখন আদর করছিল, তখন স্পষ্ট দেখছিল অবিন, ডুলু ওকে খামচে ধরেছিল পিছন থেকে৷ পরের দিন কাঁধের কাছে আঁচড়ের দাগও দেখতে পেয়েছিল অবিন৷ কথাটা বলেনি পূর্ণাকে৷ ঘরে যখন একা থাকে ডুলু, তখন যদি অবিন ঘরে ঢোকে, ডুলু অবিনকে চোখ রাঙায়৷ ডুলুকে মাঝে মাঝে অবিনের প্রতিপক্ষ বলেই মনে হয়৷ তারও যেন সমান অধিকার পূর্ণার ওপর৷ অবিন যদি পূর্ণার অর্ধেকটা চায়, তাহলে পূর্ণার বাকি অর্ধেকটা ডুলুরও চাই৷ কিন্তু অবিনের সম্পূর্ণ দাবি তো পূর্ণার ওপর৷
বাড়ি ফিরে পূর্ণা দয়ার-মার পিছনে লেগে আছে৷ আজ নিজের হাতে পূর্ণা কিছু করে খাওয়াতে চায় অবিনকে৷ একবার অবিন গলা উচিয়ে ডাক দিল,‘পূর্ণা, একবার ওপরে এসো না৷’
নীচ থেকে উত্তর এল পূর্ণার, ‘ওপরে যেতে দেরি হবে৷ অত ডাকলে কি আর কোনও কাজ করা যায়, বলো তো দয়ার-মা? আমি এখন যেতে পারব না৷’
পূর্ণা আজ খুব মন খারাপ নিয়ে বাড়ি পিরেছে৷ আজ পূর্ণার মন ভাল করে দিতে হবে৷ এখন টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করছে৷ অবিন বারান্দায় এসে দাঁড়াল৷ এই শীতের গোড়ায়ও বৃষ্টি পড়তেই কেমন সোঁদা গন্ধটা ভেসে বেড়াচ্ছে চারদিকে৷ সোঁদা গন্ধটার সঙ্গে চাঁপাফুলের গন্ধের একটা লড়াই শুরু হয়েছে যেন৷ অবিন জানে, এই গন্ধের লড়াইতে নিজেরা কেউ কখনও জেতে না৷ গন্ধের কাজই হল অন্যকে জিতিয়ে দেওয়া৷
দয়ার-মা চলে যেতে পূর্ণা দোতলায় এল, ‘বলো কী বলছিলে? দয়ার-মা আছে, অমন করে ডাকে কেউ? কী ভাবল বলো তো দযার-মা?’
‘দয়ার-মায়ের জন্য আমার বউকে আমি ডাকতে পারব না?’
‘ডাকতে পারবে না কেন?ও ভাবতেও তো পারে, ছেলেটা অমন করে বউকে ডাকছে…৷’
‘যে যাই বলুক, আমার বউ তো আমারই৷ আমারই তো ষোলো আনা অধিকার৷’
‘অধিকার নিয়ে ধুয়ে খাবে নাকি ? চলো, আজ আর দেরি করব না৷ খেয়ে নেবে চলো৷ দু’চোখ জুড়ে ঘুম আসছে৷’
খেতে বসে জানতে পারল অবিন, পূর্ণার এত সময় রান্নাঘরে থাকার ফসল হল মাশরুমের তরকারি৷ দয়ার-মা’কে দিয়ে গঞ্জের হাট থেকে মাশরুম আনিযেছে৷তারিফ করার মতোই রান্না করেছে পূর্ণা৷
খাওয়ার পর অবিন বলল, ‘চলো শীতের বৃষ্টি দেখি বারান্দায় দাঁড়িয়ে৷’
পূর্ণা অবিনের কাঁধে মাথা রেখে বলল, ‘ঘুমচোখে বৃষ্টি দেখলে কী হয় জানো?’
‘না,কী হয়?’
‘রাতে সাদা হাতির স্বপ্ন দেখে৷আর সাদা হাতির স্বপ্ন দেখলে কী হয় জানো?’
‘না, জানি না৷’
‘ডাক্তারবাবু শেষে যা বলেছেন, তাই হয়৷’ বলেই অবিনের পিঠে একটা কিল বসিয়ে দে ছুট বিছানায়৷
অবিন বারান্দায় বৃষ্টির ফোঁটা মেখে রাত-নামা দেখছিল৷ ফিরে এসে দেখল পূর্ণা ঘুমে কাদা৷ অবিন ভেবে রেখেছিল, আজ পূর্ণাকে বলবে সব কথা৷ ডুলু কে? আজ এই কথাটার উত্তর পূর্ণার কাছে জানতে চাইবে অবিন ঠিক করে রেখেছিল৷ পূর্ণা পারত কি এর উত্তর দিতে? কেন ডুলু এমন করে তাদের জীবনে ছায়ার মতো জড়িয়ে আছে? কেন তাদের জীবনকে এমন করে তিক্ততায় ভরিয়ে দিচ্ছে?ডুলুকে দুটো জীবনের মাঝখানে আর চাই না৷পূর্ণা যখন নিজে ডুলুকে সরিয়ে দিতে পারল না, তখন এ ঝুঁকি তাকেই তো নিতে হবে৷ আজ, হ্যাঁ, আজই তাকে পারতে হবে কাজটা৷
পূর্ণার ঘুমিয়ে থাকা মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকলে মন ভাল হয়ে যায়৷ এই মন ভাল থাকা অবিন-পূর্ণার গোটা জীবন জুড়ে ছড়িয়ে থাকুক৷
এই মাত্র ঠিক করল অবিন, কাল থেকে তাদের জীবনে আর কোনও ডুলু থাকবে না৷ অবিন বিছানায় শুয়ে থাকা ডুলুকে তুলে নিল৷ তোয়ালে দিয়ে জড়িয়ে টিপটিপ বৃষ্টি মাথায় করে অবিন বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়৷ অবিন জানে না, একটু পরেই হযতো ঝড় উঠবে৷ দৌড়তে শুরু করল অবিন৷ মাথার উপর অনন্ত অন্ধকারের রাত্রি৷ অবিন ছুটছে৷ এই পয়লা শীতের বৃষ্টিতেও দরদর করে ঘামছে অবিন৷ ছুটতে ছুটতে পেরিয়ে যাচ্ছে একটা ছোট শহর, একটা জনপদ, একটা দেশ, এক-একটা মহাদেশ, একটা পৃথিবী৷ আর একটা পৃথিবীর এক রঙিন প্লে স্কুলে ডুলুকে লুকিয়ে রেখে আসতে এখনও ছুটছে অবিন ৷
শনিবারের চিঠি, শারদ সংখ্যা, ১৪১৯
অঙ্কন : ডি’ সুজা